শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

চলচ্চিত্র সমালোচনা কী ও কেন

চলচ্চিত্র এমন একটি শিল্পমাধ্যম যা সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, আলোকচিত্র, নাট্যকলা ইত্যাদি মৌলিক মাধ্যমের যৌগিক সমাহারে গঠিত। সব শিল্পমাধ্যমের চাইতে বয়ঃকনিষ্ঠ হবার পরও গুরুত্ব, অডিয়েন্সের অভিগম্যতা, সামাজিক ভূমিকা ইত্যাদি বিবেচনায় বেশিরভাগ মৌলিক শিল্পমাধ্যমকে ছাপিয়ে গেছে চলচ্চিত্র।

ফলে সালভেদর দালির মতো চিত্রশিল্পীকে চলচ্চিত্রকার হতে দেখা গেছে, সের্গেই আইজেনস্টাইন, ইঙ্গমার বার্গম্যান কিংবা ঋত্বিক ঘটকের মতো থিয়েটারকর্মী চলচ্চিত্রকার বনে গেছেন। চলচ্চিত্র একটা কারখানা বা ইন্ডাস্ট্রিও বটে, অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের চাইতে বেশি পরিমাণে ইন্ডাস্ট্রি। চলচ্চিত্রের পুঁজিবাদী রূপ দর্শককে বিনোদন-বাজারের অক্রিয় ভোক্তায় অবিরত রূপান্তরিত করে, স্বপ্ন ও ভাবালুতায় মোহাচ্ছন্ন রেখে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়ায় ঠেলে দেয় এবং ক্ষমতাবানের মতাদর্শিক হাতিয়ার হয়ে দর্শকমনে আধিপত্য কায়েম করে।

অন্যদিকে এই চলচ্চিত্রই হয়ে ওঠে জনসংস্কৃতি — যেসব সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূলধন নেই, সেসব সাধারণ মানুষদের নিজস্ব সংস্কৃতি; আধিপত্যশীল উচ্চকোটির সংস্কৃতির বিপরীতে গড়ে ওঠা গণসংস্কৃতি যা ঐ উচ্চ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধরূপে হাজির হয়। চলচ্চিত্রের সামাজিকীকরণের ভূমিকাটি সম্ভবত অন্য সব শিল্পমাধ্যমের তুলনায় অনন্য। প্রেক্ষাগৃহে দলবেঁধে চলচ্চিত্র দেখার বিষয়টি যে-মাত্রায় পারিবারিক-সামাজিক উপলক্ষ্যে পরিণত হয় তা কেবল জাতীয় দিবসগুলো কিংবা ধর্মীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক উৎসবের সঙ্গেই তুলনীয় হতে পারে।

এইসব বিবিধ কারণেই চলচ্চিত্রপাঠ ও সমালোচনা হওয়া জরুরি; চলচ্চিত্রপাঠ একরকম হয়েও থাকে, সবসময়। এখন চলচ্চিত্রকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা কখনো চলচ্চিত্রবিষয়ক তত্ত্বের আশ্রয় নিতে পারি, আবার সরাসরি চলচ্চিত্রের গুণাগণ বিচার করে সমালোচনা লিখতে পারি। রিচার্ড বারসামের (বারসাম, ২০০৭) মতে, চলচ্চিত্র তত্ত্ব হলো বিশেষ কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক বা আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে চলচ্চিত্রকে বিশ্লেষণ করা। আর চলচ্চিত্র সমালোচনা সাধারণত চলচ্চিত্রের শৈল্পিক মান ও দর্শকের প্রতি আবেদনের বিশ্লেষণের ওপর আলোকপাত করে। চলচ্চিত্র লিখিতভাবে পাঠ হয় নানান উপায়ে — টিমোথি জে করিগান (করিগান, ২০০৭) বলছেন চার উপায়ে: স্ক্রিনিং রিপোর্ট, মুভি রিভিউ, তাত্ত্বিক প্রবন্ধ ও ক্রিটিকাল প্রবন্ধ।

প্রথম দুটিকে আমরা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট-রিভিউ বলতে পারি। পরের দুটিকে আমরা বলতে পারি গবেষকের ও সমালোচকের কাজ। যাহোক আলোচনার সুবিধার্থে লিখিত উপায়ে চলচ্চিত্রপাঠকে আমি তিনভাবে বর্ণনা করতে চাই: রিভিউ, সমালোচনা ও গবেষণা। চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশে এই তিন ধরনের পাঠই প্রয়োজনীয়। পত্রিকার রিভিউ একটি চলচ্চিত্রকে দর্শকের কাছে পরিচিত করে তোলে। সমালোচনাত্মক প্রবন্ধ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে দর্শক ও পরিচালকের মধ্যে একটা কার্যকর যোগসূত্র স্থাপন করে।

আর তাত্ত্বিক গবেষণা নানান প্রেক্ষাপটে (ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, জঁরা অনুযায়ী, নির্মাতা অনুযায়ী, বিষয় ও আঙ্গিক অনুযায়ী, জাতীয় চলচ্চিত্রের ধারণা অনুযায়ী ইত্যাদি) ফেলে চলচ্চিত্রের গভীর সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করে। চলচ্চিত্র সম্পর্কে দর্শকের ধ্যান-ধারণার উন্নয়নে চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখালেখি বা বিশ্লেষণের একটি ভূমিকা থাকতে পারে।

এই গ্রন্থে চলচ্চিত্রবিষয়ক যে-বিভিন্ন রচনার সমাবেশ ঘটনো হয়েছে তাকে পত্রিকার উপযোগী রিভিউ যেমন বলা যাবে না, তেমনি গভীর অনুসন্ধানমূলক গবেষণাও নয় এগুলো। রচনা হিসেবে এগুলোকে চলচ্চিত্র সমালোচনাই বলতে হবে। এখন একজন চলচ্চিত্র সমালোচকের ভূমিকা কী, চলচ্চিত্র সংস্কৃতিতে? পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক চিদানন্দ দাশগুপ্ত বলেন, সমালোচকের প্রধানতম কতর্ব্য জজিয়তি রায় দেয়া নয়। … শিল্পী ও দর্শকের মধ্যে সেতুবন্ধনেই তাঁর প্রাথমিক উদ্যোগ (দাশগুপ্ত, ২০১১: ২৩৯)। শব্দ ও চিত্রসহযোগে চলচ্চিত্রকার যে অর্থ উৎপাদন করেন, চলচ্চিত্র সমালোচনার মধ্য দিয়ে দর্শক তার একটা ব্যাখা পান।

চলচ্চিত্রের দৃশ্য প্রায়শই জটিল নন্দনতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক জায়গা থেকে গঠিত হয়, যা সাধারণ দর্শকের পক্ষে অনেকসময় অনুধাবনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। চলচ্চিত্র সমালোচকের রচনাটি চলচ্চিত্রভাষা প্রয়োগের ব্যাখা দিতে পারে ও চলচ্চিত্রটির নিরন্তর অর্থ উৎপাদনের প্রক্রিয়ার গ্রন্থি খুলে দিতে পারে, দর্শকের জন্য। অন্য দিক থেকে সমালোচকের আলোচনা নির্মাতার জন্যও উপকারী বা উপযোগী হতে পারে। এটি তার শিল্পকর্মের প্রতি অগ্রসর একজন চলচ্চিত্রামোদীর সাড়া হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সমালোচনা থেকে নির্মাতা তার কাজের শক্তির দিকটি যেমন জানতে পারেন, তেমনি সমালোচকের ধরিয়ে দেয়া নানান অসঙ্গতি বা সীমাবদ্ধতা নির্মাতার পরবর্তী কাজে আরও সতর্ক হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। কিন্তু এরকমটি যে সবসময় হয়না, তা দৃশ্যমান।

চিদানন্দ দাশগুপ্ত বলেন, দুঃখের বিষয় এখনও আমাদের চলচ্চিত্র-সমালেচনা সাহিত্য হয় বক্তব্যধর্মী সাহিত্য ঘেঁষা পাণ্ডিত্যের আধার, নয় জজিয়তি রায়প্রবণ, অথবা প্রচার বা অপপ্রচারের হাতিয়ার। চলচ্চিত্রের স্বধর্মে আমাদের শিল্পকর্ম যতটা প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে, আমাদের সমালোচনা ততটা নয়। ফলে শিল্পী ও সমালোচকের সম্পর্ক হয় উত্তমর্ণ-অধমর্ণের, নয় অহি-নকুলের (দাশগুপ্ত, ২০১১: ২৩৯)। ‘সাহিত্য ঘেঁষা পাণ্ডিত্যের আধার’ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সমালোচক সেবাব্রত গুপ্তর কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়, যিনি সত্যজিৎ রায়ের প্রথম দিককার চলচ্চিত্র নিয়ে লিখে পরিচালকের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছিলেন। তিনি দেশ পত্রিকায় অপুর সংসার নিয়ে সমালোচনা লেখার প্রেক্ষাপটে বলছেন:

তখনো সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের অভিন্ন সম্পর্কে বিশ্বাস করতাম এবং গল্পের কিছুটা অদলবদল দেখলেই নিরাশ হতাম। এই মানসিকতা নিয়েই ‘অপুর সংসার’-এর সমালোচনা করেছিলাম। এই কারণে আমার সমালোচনার প্রতিবাদে সত্যজিৎ রাযকে তাঁর সেই বিখ্যাত চিঠি লিখতে হয়েছিল। … আমার সমালোচনায় অবশ্য সত্যজিৎ বাবুর চলচ্চিত্রকর্মের ভূয়সী প্রশংসাও ছিল। লেখা হয়েছিল — “অপু-কাহিনীর এই অধ্যয়নের চিত্ররূপায়ণে সত্যজিৎ রায়ের অনন্যসাধারণ প্রয়োগশিল্পের আশ্চর্য দীপ্তি আলিপ্ত হয়ে আছে ছবির সর্বাঙ্গে। ছবির অনন্য শিল্পমহিমা ও রূপরীতি, ব্যঞ্জনা ও ইঙ্গিতের সূক্ষ্ম অথচ সহজবোধ্য বিন্যাস এবং সর্বোপরি এর নিরুচ্ছ্বাস গীতিময়তা দর্শকের অনুভূতিকে পুলকিত ও বিস্মিত করে” (গুপ্ত, ২০১১: ২৪১-২)।

এযুগে অবশ্য কেউই এইরকম করে সাহিত্যের ডুবসাঁতারে সমালোচনা লেখেন না। সেরকম করে লিখলে শিল্পী ও দর্শকের সেতুবন্ধনের চাইতে বিদ্যমান নড়বড়ে সেতুর চূড়ান্ত ধ্বংস সাধিত হবে। সমালোচনার আদি প্রকরণের একটি নমুনা হিসেবে সেবাব্রত গুপ্তের উদ্ধৃতিটি এখানে হাজির করা হলো। তিনি অবশ্য নিজেই প্রকারন্তরে স্বীকার করেছেন একসময়ের আলঙ্কারিক শব্দব্যবহারের বিষয়টি এখন আর কার্যকর নয়।

চলচ্চিত্রকার এবং চলচ্চিত্র সমালোচকের পারস্পরিক সম্পর্ক সবসময়ই প্রতিপক্ষের সম্পর্কে পর্যবেশিত হবার ঝুঁকির মধ্যে থাকে, যদিও উভয়েরই কাজের লক্ষ্য একই Ñ উন্নত চলচ্চিত্র। তাদের ভূমিকা পরস্পরকে সমর্থন দেয়া, পরস্পরকে উচ্ছেদ করা নয় (কবির, ১৯৭৯: ১০৪)। চলচ্চিত্র সংস্কৃতিতে সমালোচকের উপস্থিতি যেমন চলচ্চিত্রকারকে শৈল্পিক মান রক্ষায় মনোযোগী করে, তেমনি একটি সত্যিকারের শৈল্পিক চলচ্চিত্র সমালোচকের বুদ্ধিবৃত্তিক দৌড় পরীক্ষার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আলমগীর কবিরের মতে, অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের সমালোচকের মতোই একজন চলচ্চিত্র সমালোচকের কাজ হলো চলচ্চিত্রটির শৈল্পিক মান বিচার করা এবং শিল্পের বস্তুগত প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সমাজ ও মানুষের প্রতি এর অবদানকে বিচার করা (কবির, ১৯৭৯: ১০৫-৬)।

একজন সমালোচককে সব কাজের কাজী হতে হয়, সব শিল্পমাধ্যমের ওপর তার দখল থাকা চাই। উপরন্তু, আলমগীর কবির মনে করেন ইতিহাস, রাজনীতি, সামাজিক বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংগীত, নাট্যকলা, চিত্রকলা এবং অন্যান্য মাধ্যমের সাম্প্রতিক অগ্রগতি সম্পর্কে চলচ্চিত্র সমালোচকের ধারণা থাকতে হয়। যদি সম্ভব হয়, তাকে বিজ্ঞানের সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কেও জানতে হবে। কারণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার শিল্পমাধ্যমের অগ্রগতিতেও প্রভাবিত করে (কবির, ১৯৭৯: ১০৬-৭)। সহজ উদাহরণ হলো, ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে চলচ্চিত্রের উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবেশনে বিপুল পরিবর্তন এসে গেছে। সমালোচকের এই পরিবর্তন বা বিবর্তন সম্পর্কে উপলব্ধি না থাকলে চলচ্চিত্র বিদ্যমান অনেক ইফেক্ট, অনেক নিরীক্ষা ধরতে ব্যর্থ হবেন।

একসময় চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখালেখি মানেই ছিল প্রচারমূলক আলোচনা। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে সমালোচনার বিষয়টি এসেছে। এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণাও। একসময় কেবলই চলচ্চিত্রের টেক্সট নিয়ে আলোচনা হতো, পরে টেক্সটের বাইরে সমাজ, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাস, জাতীয়তা এমনকি দর্শক মনস্তত্ত্বকে যুক্ত করে চলচ্চিত্রকে বৃহত্তর পরিসরের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ফলে চলচ্চিত্র নিয়ে লেখা খুব সহজ কাজ নয়। বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাঁ লুক গদার বলতেন যে কাইয়ে-দ্যু-সিনেমার জন্য কোনো প্রবন্ধ লেখা একটা ফিল্ম বানানোর মতোই একটা পরিশ্রমের কাজ ছিল (মোকাম্মেল উদ্ধৃত, তারিখবিহীন)।

আজ চলচ্চিত্র সমালোচনা কেবল চলচ্চিত্রের আধেয় ও আঙ্গিকে বা টেক্সটে মনোযোগী থাকেনা — ফলে অন্যান্য শিল্পমাধ্যম যেমন সাহিত্য, সংগীত, আলোকচিত্র, চিত্রকলা ইত্যাদির ওপর দখল থাকা সমালোচকের টেক্সুয়াল বিশ্লেষণ করেও পার পাবার যো নেই। চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ প্রায়ই কনটেক্সুয়াল জায়গায় আলোকপাত করে Ñ অর্থাৎ চলচ্চিত্রের সঙ্গে তৎকালীন রাজনীতি, ইতিহাস, উৎপাদনপদ্ধতি, জাতি-লিঙ্গ-বর্ণের প্রসঙ্গগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেই চলচ্চিত্রকে বিশ্লেষণ করতে হয়। ফর্মালিজম একসময়ের বহুল প্রচলিত চলচ্চিত্র-সমালোচনার ধরন ছিল; কিন্তু এখন উত্তর-কাঠামোবাদী ধারায় মনঃসমীক্ষণ, নয়া মার্কসবাদ, নারীবাদ ইত্যাদি প্রসঙ্গ যুক্ত হয়ে চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ নানামাত্রিক রূপ নিয়েছে।

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই চলচ্চিত্র নিয়ে সমালোচনা-বিশ্লেষণ হয়ে আসছে, যদিও ধারাটি সবল নয়। জাকির হোসেন রাজু (রাজু, ২০০৫) বাংলাদেশে চলচ্চিত্র অধ্যয়নের ক্ষেত্রে দু’টি ধারা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন: মূলধারার সাংবাদিকতা (আমার বিবেচনায় রিভিউ) এবং সমালোচনামূলক আস্বাদন (আমার বিবেচনায় সমালোচনা)। তিনি বলছেন এই দুই ধারা আবার ‘চলচ্চিত্র কী’ এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রথম ধারা চলচ্চিত্রকে দেখে কারখানা হিসেবে আর দ্বিতীয় ধারাটি দেখে সুকুমার কলা হিসেবে।

প্রথম অংশের লেখক অর্থাৎ পত্র-পত্রিকার সাংবাদিকদের সঙ্গে কারখানার সম্পর্ক আবার প্রত্যক্ষ ছিল — কেউ চিত্রনাট্য লিখেছেন আবার কেউবা চলচ্চিত্র নির্মাণও করেছেন। আর দ্বিতীয় ধারার লেখকরা ছিলেন চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী বা বুদ্ধিজীবী, যারা চলচ্চিত্রকে সুকুমার কলার বাইরে আর কিছু ভাবতে নারাজ। ফলে জনপ্রিয় ধারার চলচ্চিত্রকে তাত্ত্বিকভাবে পাঠের যে চল পঞ্চাশ-ষাটের দশক থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় শুরু হয়েছে বৃহত্তর জনসংস্কৃতি অধ্যয়নের অংশ হিসেবে, তার চর্চা আমাদের দেশে তেমন দেখা যায়নি।

আবার টেক্সুয়াল বিশ্লেষণের বাইরে এসে চলচ্চিত্র দর্শককে নিয়েও তেমন কাজ হয়নি। ২০০৫ সালে রাজু যখন এই পর্যবেক্ষণ হাজির করছেন, তার পরবর্তী সময়ে অবশ্য পরিস্থিতির সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে মন্দাভাবের পাশাপাশি চলচ্চিত্র রিভিউ বা সিনে সাংবাদিকতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। চলচ্চিত্রবিষয়ক কোনো পত্রিকা এখন আর দেখা যায়না। দৈনিকে যে-ধরনের সিনে-সাংবাদিকতা হয় তা অতিমাত্রায় তারকানির্ভর, চলচ্চিত্র পর্যালোচনা পুরো অনুপস্থিত। বরং অনলাইনে ব্লগার বা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অনেকে এখন চলচ্চিত্র রিভিউ ধারাটিকে টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তাত্ত্বিক গবেষণার একটি ধারা উঁকিঝুঁকি মারছে। গবেষণা-প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়েছে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ। এদিকে চলচ্চিত্র সমালোচনা ধারাটিও স্রোতস্বিনী হয়ে উঠছে না। সবমিলিয়ে বলা যায়, লিখিত উপায়ে চলচ্চিত্রপাঠের পরিস্থিতি নিয়ে আনন্দিত হবার কারণ ঘটছে না। ইন্ডাস্ট্রিতে চলচ্চিত্রব্যবসা যদি চাঙ্গা থাকতো, বা স্বাধীনধারার চলচ্চিত্রের অবস্থা যদি রমরমা হতো, তবে সমালোচকের দিক থেকে চলচ্চিত্রপাঠের পরিস্থিতি হয়তো আরেকটু ভালো থাকতো। বলা দরকার, এই মুহূর্তে চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখক-সমালোচকের সংখ্যা পূর্বের যেকোনো সময়ের চাইতে বেশি রয়েছে। চলচ্চিত্রবিষয়ক গ্রন্থের সংখ্যাও পূর্বের তুলনায় বেড়েছে।

তথ্যসূত্র
# কবির, আলমগীর (১৯৭৯)। Film in Bangladesh. Dhaka: Bangla Acdemy.

# করিগান, টিমোথি জে. (২০০৯)। A Short Guide to Writing About Film (6th ed.). New Delhi: Pearson.

# গুপ্ত, সেবাব্রত (২০১১)। চলচ্চিত্র সমালোচনার দায়-দায়িত্ব: আমার অভিজ্ঞতা, শতবর্ষে চলচ্চিত্র (১ম খণ্ড)। নির্মাল্য আচার্য ও দিব্যেন্দু পালিত সম্পা. (২য় সংস্করণ)। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।

# দাশগুপ্ত, চিদানন্দ (২০১১)। সমালোচনার দায় ও দায়িত্ব, শতবর্ষে চলচ্চিত্র (১ম খণ্ড)। নির্মাল্য আচার্য ও দিব্যেন্দু পালিত সম্পা. (২য় সংস্করণ)। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।

# বারসাম, রিচার্ড (২০০৭)। Looking at Movies: An Introduction to Film (2nd ed.). New York: W. W. Norton & Company, Inc.

# মোকাম্মেল, তানভীর (তারিখবিহীন)। চলচ্চিত্র-সমালোচনা: একটি উপক্রমণিকা, ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন। জহিরুল ইসলাম কচি সম্পা.। ঢাকা: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চলচ্চিত্র চক্র।

# রাজু, জাকির হোসেন (২০০৫)। চলচ্চিত্র বিশ্লেষণের বিভিন্ন ধারা ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র চর্চা, যোগাযোগ। সংখ্যা ৭, ফেব্র“য়ারি ২০০৫।
[চলচ্চিত্র সমালোচনা (ফাহমিদুল হক, ২০১৩, আগামী, ঢাকা) গ্রন্থ থেকে]

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

এই সপ্তাহের পাঠকপ্রিয়