মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

সেন্সর বোর্ডের সদস্য হলেন চলচ্চিত্রকার দেওয়ান নজরুল

চলচ্চিত্রকার বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান নজরুল। -- চিত্রজগত.কম

বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান নজরুলকে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য করা হয়েছে। তিনি দেশীয় চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান পরিচালক, প্রযোজক ও গীতিকার। ওয়েস্টার্ন ঘরানা সারা বিশ্বের চলচ্চিত্রে অতিচর্চিত একটি বিষয়। বাংলা চলচ্চিত্রে সর্বপ্রথম এ ধারার সম্পূর্ণ কোন ছবি নির্মাণের সাহস করেন পরিচালক দেওয়ান নজরুল। প্রায় ৪৩ বছর আগে ‘আসামী হাজির’ নির্মাণ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ওয়েস্টার্ন ছবিতে আমরাও কোন অংশে কম নই। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বকে সেন্সর বোর্ডের সদস্য করায় চলচ্চিত্রাঙ্গনের মানুষেরা তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদের প্রশংসা করছেন।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের সেন্সর বোর্ডের ১৫ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (চলচ্চিত্র)ও বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সহ-সভাপতিকে এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া পদাধিকার বলে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি)’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজাত ইয়াসমিন (অতিরিক্ত সচিব) ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা কাজী হায়াতকে এ কমিটির সদস্য করা হয়েছে।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের অন্যান্য সদস্যরা হলেন: বিশিষ্ট চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সুজাতা আজিম, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা দেওয়ান নজরুল, চিত্রনায়িকা রোজিনা, চিত্রনায়িকা অরুনা বিশ্বাস, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াত, বিশিষ্ট অভিনেত্রী ও সাংবাদিক ফাল্গুনী হামিদ, ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতির সাবেক সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু।

এই কমিটি আগামী ১৬ এপ্রিল থেকে ১৯৬৩ সালের সেন্সরশিপ আইনের ধারা ৩ এবং ১৯৭৭ সালের বাংলাদেশ সেন্সরশিপ অব ফিল্মস রুলসের বিধি ৪ মোতাবেক আগামী ১ বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করবেন।

নতুন এ দায়িত্বে নিয়োজিত হওয়ার সংবাদ জানার পর দেওয়ান নজরুলের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেন্সর বোর্ড একটি দায়িত্বশীল জায়গা। এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সদস্য হিসেবে থাকা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। আমি চেষ্টা করব, দেশীয় সিনেমার স্বার্থে নিজের মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে। আমাকে কমিটিতে রাখার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাই।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান নজরুল-এর জন্ম ও শৈশব
দেওয়ান নজরুল ১৯৫০ সালে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম দেওয়ান সাবির হোসেন এবং মায়ের নাম শরিফা বেগম। সিরাজগঞ্জ থেকে স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত ‘যমুনা’ পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তার লেখালেখির জীবন শুরু হয়।

কৈশোরকাল
১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ‘দৈনিক স্বদেশ’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি এই পত্রিকার সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে দায়িত্বলাভ করেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি কবিতা লিখতেন। ‘কে তুমি’ চলচ্চিত্রে গান লিখার মধ্য দিয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রবেশ করেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যোগদান করেন। তিনি ৭ নাম্বার সেক্টরের অধীনে পাবনা অঞ্চলে যুদ্ধ করেছিলেন।

চলচ্চিত্র নির্মাণ
দেওয়ান নজরুল চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে যুক্ত হন ইবনে মিজান পরিচালিত ‘নাগিনীর প্রেম’ চলচ্চিত্রে শিক্ষানবিশ হিসেবে। ১৯৭৪ সালে ইবনে মিজান পরিচালিত ‘ডাকু মনসুর’, ‘দুই রাজকুমার’, ‘নিশান’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘জিঘাংসা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক এবং ‘বাহাদুর’ চলচ্চিত্রে প্রধান সহকারী পরিচালক ও গীতিকার হিসেবে কাজ করেন।

পরিচালক ইবনে মিজানের সঙ্গে শেষ কাজ নিশান চলচ্চিত্রে। এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। প্রধান সহকারী পরিচালক থেকে পরিচালক হিসেবে দেওয়ান নজরুলের প্রথম চলচ্চিত্র ‘আসামী হাজির’। তবে কোন কারণে চলচ্চিত্রটির কাজ শেষ করতে পারেন নি।

এরপর তিনি ১৯৭৬ সালে শুরু করেন ‘দোস্ত দুশমন’ চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ। ১৯৭৭ সালে তা মুক্তি পায়। এটিই দেওয়ান নজরুল পরিচালিত প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র। এ চলচ্চিত্রে জসিম খল চরিত্রে অভিনয় করে দারুন খ্যাতি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি অ্যাকশন হিরো হিসেবে ঢাকাই চলচ্চিত্রে স্থান করে নিয়েছিলেন। ‘দোস্ত দুশমন’ চলচ্চিত্রটি বিখ্যাত হয় এবং দেওয়ান নজরুল পরিচালক হিসেবে স্থায়ী আসন লাভ করেন। এ চলচ্চিত্রে পশ্চিমা ধারার মারামারির দৃশ্য সফলভাবে চিত্রায়িত হয়। এরপর তিনি তার পূর্বের অর্ধ সমাপ্ত ‘আসামি হাজির’ চলচ্চিত্রটি পুণঃনির্মাণের উদ্যোগ নেন। পরবর্তীতে এটিও ব্যাবসা সফল চলচ্চিত্র হিসেবে ঢাকাই চলচ্চিত্রে সুনাম অর্জন করে।

চিত্র নায়ক রিয়াজ দেওয়ান নজরুলের মাধ্যমে “বাংলার নায়ক” চলচ্চিত্রে নাম লেখান। দেওয়ান নজরুলের সহকারী এবং প্রধান সহকারী পরিচালকেরা এখন চলচ্চিত্র বা টিভির জগতে নামকরা মুখ। তাদের মধ্যে রয়েছেন অভিনেতা কায়েস চৌধুরী, পরিচালক রায়হান মুজিব, পরিচালক রানা নাসের এবং পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান।

দেওয়ান নজরুল পরিচালিত “জনি” চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে যশোরে “মনিহার” সিনেমার যাত্রা শুরু হয়েছিল।

দেওয়ান নজরুল পরিচালিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো:
দোস্ত দুশমন (১৯৭৭) একটি কালজয়ী চলচ্চিত্র, বারুদ (১৯৭৮), আসামী হাজির (১৯৭৯), জনি (১৯৮৩), কুরবানি, ধর্ম আমার মা (১৯৮৬), আসমান জমিন, মাটির দুর্গ, লিঞ্জা (প্রয়োজক), মাস্তান রাজা (১৯৯২), কালিয়া (একটি কালজয়ী চলচ্চিত্র) ১৯৯৩, বাংলার নায়ক (১৯৯৫), সুজন বন্ধু, দোজখ (২০০৫)।

তিনি আসামী হাজির (১৯৭৮) সিনেমার চিত্রনাট্য, সংলাপ ও কাহিনি রচনা করেছেন।

দেওয়ান নজরুল বেশকিছু চলচ্চিত্রে গীতিকার হিসেবেও কাজ করেছেন। তার লেখা চলচ্চিত্রের অধিকাংশ গানই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে-

কে তুমি (১৯৭৩), জিঘাংসা (১৯৭৪), বাহাদুর (১৯৭৬), দোস্ত দুশমন (১৯৭৭), আসামী হাজির (১৯৭৮), প্রিয়জন (১৯৯৬), আজকের হাঙ্গামা, ভালোবাসলে দোষ কি তাতে (২০১৪), এবং হিরো সিনেমায়।

দেওয়ান নজরুল অসংখ্য কালজয়ী গান লিখেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

‘চুপি চুপি বল কেউ জেনে যাবে’, ‘চুমকি চলেছে একা পথে’, ‘রূপে আমার আগুন জ্বলে’, ‘ও সাগর কন্যারে কাঁচা সোনার গাঁয়’, ‘রেললাইনের ঐ বস্তিতে (আজম খান)’, ‘আজকে না হয় ভালোবাসো’, ‘পাখির বাসার মত দুটি চোখ তোমার’, ‘দুনিয়াটা মস্ত বড় খাও দাও ফুর্তি করো’, ‘নাচ আমার ময়না তুই পয়সা পাবি রে’, ‘বলে দাও মাটির পৃথিবী’, ‘এত রূপের করিস না.. ওই রূপ চিরদিন থাকবে না’, ‘তুমিতো এখন আমারই কথা ভাবছো’, ‘দোস্ত আমরা দু’জন.. হবোনা দুশমন’ প্রভৃতি।

চিত্রজগত ডটকম/সিনেমা

সংশ্লিষ্ট সংবাদ