শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

ডিজিটাল আসক্তিকে ‘না’ বলুন

আমাদের প্রতিদিনের জীবনে প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষার্জনের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের আবশ্যকতা অপরিহার্য। আজকাল যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বপ্রথম আমরা ইন্টারনেটকেই নির্ভরযোগ্য মনে করি। আর সেই নির্ভরশীলতা থেকে যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত আমরা ইন্টারনেটে সময় ব্যয় করি তখন আমাদের ব্যক্তিগত, শারীরিক ও নানা রকম পারিবারিক সমস্যায় পতিত হই।

আর এতে করে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন। আর এই অনিয়ম ও অনিয়ন্ত্রিত সময় ইন্টারনেটে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যয়ের ফলে হয়ে যেতে পারে অনেক বড় ক্ষতি। সেজন্য আমরা একে বলি ইন্টারনেটে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের নাম আসক্তি। ইন্টারনেট আসক্তি এক ধরনের ব্যাধি হিসেবে পরিচিত। সাধারণত ইন্টারনেট আসক্তি বলতে বোঝায় অনলাইন সম্পর্কিত যে কোনো ধরনের অনিয়ন্ত্রিত আচরণ, যার দ্বারা স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়।

মনোবিজ্ঞনীদের মতে, যখন কোনো ব্যক্তি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে এর ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ইন্টারনেট ব্যবহার ছাড়া সে থাকতে পারে না ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে তার স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়। অসংখ্য ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে যারা মূলত নিজের বাহ্যিক সৌন্দর্য কিংবা ব্যক্তিগত গুণাবলির বহির্প্রকাশ করতে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, লিংকডিন, টুইটার. ইউটিউবের পাশাপাশি ব্লগ ও ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে বিভিন্ন রকমের লিখিত কন্টেন্ট অথবা ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করে মানুষের সম্মুখে জাহির করতে চায়।

বেশি ভিউয়ার ও লাইক পাওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় যাতে করে অতিদ্রুত সেলিব্রিটি বনে যাওয়া যায় ও প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়। সেজন্য সর্বদা তাদের চোখ থাকে ইন্টারনেটের ওপর এবং যেন যে কোনো প্রকার আপডেট তারা মিস না করে ফেলে। কিন্তু তারা বুঝতেই পারে না এতে তাদের ইন্টারনেট আসক্তির মতো বাজে অভ্যাস গড়ে তুলছে। এ ছাড়াও অসংখ্য ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রতিনিয়ত নানা রকমের ভিডিও, ক্ষুদ্রাকৃতির সিনেমা ও নাটক বানিয়ে অথবা কৌতুক, ট্রল, টিকটক, ক্রিয়েটিভ কাজের রিভিউ, ফেসবুক লাইভ, উপস্থাপনা ও প্রাঙ্ক ভিডিও তৈরি করার মাধ্যমে তারা একটি বিনোদনের উৎস বানিয়ে সেটাকে ইউটিউব, ফেসবুকসহ সব সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে।

আর এই প্রক্রিয়ায় তারা নিজেরা যেমন সর্বদা অনলাইনে থাকে তেমনি, একটা গ্রুপ যারা তাদের এসব ভিডিও পছন্দ করে, মন্তব্য করে এবং শেয়ার করে সেই সব অডিয়েন্সও ইন্টারনেট আসক্তির গন্ডিতে আবদ্ধ হয়।

ডিজিটাল আসক্তির তিনটি ধরন রয়েছে; যথা- ফোন আসক্তি, ইন্টারনেট আসক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি।
সব বয়সের মানুষের মধ্যে এ আসক্তি দেখা দিলেও কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীরা এ আসক্তিতে বেশি আক্রান্ত। ছাত্র, শিক্ষকসহ প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বর্তমানে ফেসবুকের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে শিক্ষাধারা অব্যাহত রাখতে অনলাইন শিক্ষার প্ল্যাটফরমই একমাত্র অবলম্বন। কারণে-অকারণে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে বসতে হয়। দীর্ঘ সময় ধরে অনলাইন শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা ক্লাসের অন্তরালে ঝুঁকে পড়ছে নানা ধরনের অপ্রাসঙ্গিক বিনোদনে যা তাদের মারাত্মকভাবে আসক্ত করে তুলছে। এই আসক্তি তাদের সৃজনশীল শক্তিকে দুর্বল করছে। এবং আসক্তি কখনো কখনো আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর পথে ডেকে নিচ্ছে। মাদকের আসক্তির মতো, অনলাইন গেম থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন। তবে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বা পরিসেবায় নিজেকে জড়িত রেখে গেমের আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

তরুণ প্রজন্মকে যদি আসক্তি থেকে মুক্তি দেওয়া না যায়, তবে তাদের একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তদুপরি, শিশুদের এ জাতীয় আসক্তি থেকে বাঁচাতে অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়া দরকার। আমাদের অনলাইন বিশ্বে শিক্ষার্থীদের জন্য মানবিক ও স্বাস্থ্যকর বিনোদন নিশ্চিত করতে হবে, তাদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় জড়িত হতে উৎসাহিত করতে হবে, ফেসবুকের ভালো ও শিক্ষণীয় স্টোরিগুলো ব্যবহারে নির্দিষ্ট পদ্ধতি বের করতে হবে। সরকার ইন্টারনেটভিত্তিক এ জাতীয় বিনোদন ব্যবহারে কঠোর আইনি বিধিনিষেধ জারি করতে পারে। আমাদের শিক্ষার্থীদের সামাজিক সুরক্ষা নীতি বজায় রেখে খেলার মাঠে যেতে এবং খেলার ব্যবস্থা করতে দেওয়া উচিত।

তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং বিশ্বে তাদের সাফল্যের শিখরে পৌঁছানোর জন্য মাদকের আসক্তিকে আমরা ‘না’ বলার পাশাপাশি ডিজিটাল আসক্তিকে আমাদের ‘না’ বলতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে- এখন ক্ষতটি ছোট, এটি ওষুধ দিয়ে নিরাময় করা যাবে, তবে ক্ষতটি বড় হয়ে গেলে তা নিরাময় করা কঠিন হবে। সুতরাং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমাদের তরুণ প্রজš§ শিক্ষার্থীদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনি এবং অনলাইনভিত্তিক সব গেম ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করি।

ইন্টারনেট আমাদের জীবনে অসামান্য আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভাব হলেও এর ফলে সারা পৃথিবীর মানুষ এখন এক ভয়াবহ হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। মানবেতর জীবনযাপনের ক্ষেত্রে নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ঘটছে অবর্ণনীয় অবক্ষয়। এমনকি অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে আমাদের দেশের অপার সম্ভাবনাময় শিশুরা। মেধা আর মননে শিশুদের বিকশিত হওয়ার অন্তরায় হয়ে উঠছে এই আসক্তি। পরিণামে অসহায় হয়ে পড়ছেন বাবা-মা, অশান্তি নেমে আসছে পারিবারিক জীবনে। অনলাইন গেমের এই আসক্তি থেকে শিশুদের রক্ষা করতেই হবে।

লেখক: রায়হান আহমেদ : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

চিত্রজগত/আর.কে

সংশ্লিষ্ট সংবাদ