স্মরণ: বিশিষ্ট অভিনেতা ও শব্দগ্রাহক এ কে কোরেশী’র পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

বিশিষ্ট অভিনেতা ও শব্দগ্রাহক এ কে কোরেশী’র পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে স্বপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে, ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি, লস এঞ্জেলসের একটি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তাঁকে লস এঞ্জেলসের পামডেল কবরস্থানে স্ত্রীর কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুদিবস-এ তাঁর প্রতি বিন্ম্র শ্রদ্ধা জানাই। চিত্রজগত পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
এ কে কোরেশী (আজিজুল কাদের কোরেশী) ১৯৩৭ সালের ৮ এপ্রিল, ভারতের চব্বিশপরগণার বশিরহাট গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। বাবা- ইবনে আহমেদ কোরেশী, মা- মোসাম্মাৎ নুরুন্নেসা। তাঁরা ৬ বোন, ৩ ভাই। তাঁর বড় ভাই আলম কোরেশী (আজিজুল আলম কোরেশী) একজন গুণী চলচ্চিত্র সম্পাদক ছিলেন।
এ কে কোরেশী প্রাথমিক পড়াশোনা করেছেন হাওড়ার মজু পাঠশালায়। তাঁর বাবা তখন হাওড়া স্টেশনের মাস্টার ছিলেন। হাজী ইস্পাহানী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে ম্যট্রিকুলেশন, এরপর কোলকাতা সিটি কলেজ ও সেন্ট জেভিয়ার কলেজ থেকে আই এস সি (বিজ্ঞান) পাস করেন।
১৯৫৪ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন এ কে কোরেশী। এক সময় কমিশন লাভ করে জিডি পাইলট পদে উত্তীর্ন হন। পরবর্তিতে পাকিস্তানীদের বৈষম্যমুলক আচরণের কারণে তিনি ১৯৫৬ সালে বিমান বাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।
১৯৫৬ সালে জনসংযোগ অধিদপ্তরের চলচ্চিত্র বিভাগে শব্দগ্রাহক হিসেবে যোগদান করেন। এই বিভাগই ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল ‘এফডিসি’তে রূপান্তর হয়। এফডিসি’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে এ কে কোরেশী অন্যতম।
তিনি ১৯৬৫ সালে ‘বারী স্টুডিও’তে ও ১৯৬৮ সালে পিটিভি (বিটিভি)-তে যোগ দেন। বিটিভি’র ফিল্ম শাখার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ আউটডোর নিউজ সেকশনের সদস্য হিসেবে রাস্ট্রপ্রধানের সাথে বিভিন্ন দেশ সফর করেন তিনি। ১৯৭৬ সালে বিটিভির বৈদেশিক ক্রয় নির্বাহী পদে নিয়োগ পান। সর্বশেষ বিটিভি’র বৈদেশিক অনুষ্ঠান ক্রয় বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন ১৯৯৪ সালে।
১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ক্যায়সে কহুঁ’ ছবিতে প্রথম পুর্ণাঙ্গ শব্দগ্রাহক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং পাশাপাশি তিনি অভিনয়ও শুরু করেন। অনেক ছবির শব্দগ্রাহক হিসেবে কাজ করা এ কে কোরেশী অভিনয়ও করেছেন বহু চলচ্চিত্রে। শব্দগ্রাহক ও অভিনেতা হিসেবে যেসব ছবিতে তিনি কাজ করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ক্যায়সে কহুঁ, অনেক দিনের চেনা, ম্যায় ভি ইনসান হুঁ, অভিশাপ, ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো, এত টুকু আশা, বালা, অপরিচিতা, নীল আকাশের নীচে, সোনার হরিন, ক খ গ ঘ ঙ, মায়ার সংসার, দেবর ভাবী, প্রতিনিধি, অন্তরঙ্গ, অর্পণ, গাদ্দার, জনি, জীবন নৌকা, জজ ব্যারিস্টার, ক্রিমিনাল, স্নেহের প্রতিদান, কেয়ামত থেকে কেয়ামত, বুকের ভেতর আগুন, মহামিলন, অনন্ত ভালবাসা, লাট সাহেব, উত্তরের খেপ, লণ্ড ভণ্ড, হাছন রাজা প্রভৃতি।
মেধাবী শব্দগ্রাহক এ কে কোরেশী অভিনেতা হিসেবে ছিলেন আলোচিত ও জনপ্রিয়। চলচ্চিত্র অথবা নাটকে দর্শক তাঁকে দেখত জজ সাহেব, ডাক্তার, পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, উকিল, সৎ আদর্শবান ও অভিজাত ব্যক্তিত্বের প্রতীক হিসেবে। অনেক ছবিতেই তিনি জজ সাহেব চরিত্রে অভিনয় করেছেন এবং তাঁকে সাদাচুলের জজসাহেব চরিত্রে পরিচালকরা যেমন নিতেন, দর্শকরাও তাঁকে পছন্দ করতেন। তাঁর মতো জজের ভূমিকায় বিশ্বাসযোগ্য অভিনেতা আসলে ছিল না- বললেই চলে। তিনি যখন জজের ভূমিকায় অভিনয় করতেন, মনে হতো আসলেই একটি বিচারকার্য পরিচালনা হচ্ছে।
এ কে কোরেশী সম্ভবত একমাত্র বাংলাদেশি অভিনেতা, যিনি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় মার্কিন টিভি সিরিজ ‘The X Fiels’ ও ‘L A Law’-তে অভিনয় করেছেন।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার, বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার। সমাজসেবায় ‘আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম’ পুরস্কার- ১৯৯৬, ১৯৯৭, ১৯৯৮। গেন্ডারিয়া কচিকাঁচার মেলা’র প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। কচিকাঁচার মেলার একটি ভবনের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে- ‘এ কে কোরেশী ভবন’।
ব্যক্তিজীবনে এ কে কোরেশী কন্ঠশিল্পী রোজী করিম-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রী রোজী করিম হলেন প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দিনের ছোট ভাই স্বনামধন্য গীতিকার আব্দুল করিমের বড় মেয়ে। এ কে কোরেশী-রোজী করিম দম্পতীর দুই পুত্র- ফয়সাল কোরেশী ও ফরহাদ কোরেশী। আর একমাত্র কন্যা- ফাররুজ কোরেশী কান্তা।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রচুর নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। অভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। অভিনয় করেছেন মঞ্চ ও বেতার নাটকেও। সেই সময়ে টেলিভিশনে কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ও টেলিভিশনে তাঁর অবদান অনিস্বীকার্য। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ‘পুলিশ অফিসার’ ও ‘জজ (বিচারক)’ এই দুইটি চরিত্রে বাস্তবসম্মত অভিনয় করে এ কে কোরেশী চির স্মরণীয় হয়ে আছেন। (কৃতজ্ঞতা: মীর শামছুল আলম বাবু)
চিত্রজগত/ঢালিউড