যেভাবে বলিউডের ব্যবসাও দখলে নিচ্ছে দক্ষিণী সিনেমা

বছর সাতেক আগে সর্বভারতীয় বক্স অফিসে তুমুল সাড়া ফেলেছিল বাহুবলি। তারই পথ ধরে কেজিএফ-২, আরআরআর ও পুস্পার সাফল্য এখন দক্ষিণী সিনেমার সামনে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলেছে।
উপমহাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পে শুরুর যুগ থেকেই এতদিন ভারতীয় চলচ্চিত্র সমার্থক হিসাবে বলিউডকেই দেখা হতো। সে তুলনায় ভারতের অন্যান্য প্রদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে সন্তুষ্ট থাকতে হতো ‘আঞ্চলিক’ তকমা নিয়ে । কিন্তু, বলিউড হয়তো পায়ের নিচের মাটি হারাচ্ছে, সে জায়গা করে নিতে অগ্রণী হয়ে উঠেছে দক্ষিণ ভারতের বিনোদন ভুবন।
এ অঞ্চলের বিনোদন জগতের হালচিত্র জানেন না এমন মানুষের কাছে এ দাবি হতে পারে অবিশ্বাস্য। ভাববেন সত্যিই কী এ-ও সম্ভব। অথচ, সেই ভেলকিই দেখাচ্ছে দক্ষিণী ‘ফিল্ম মেকিং’।
যেমন গত সপ্তাহে কানাড়া ভাষার ফিল্ম কেজিএফ-২ ভারতের প্রধান প্রধান কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়ে ভারতজুড়ে সাড়ে ৪ হাজার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। অথচ, সাধারণত এত বিপুল সংখ্যক সিনেমা হলে মুক্তির ঘটনা সাধারণত আগে কেবল বলিউডের সালমান খানের মতো সুপারস্টারদের ক্ষেত্রেই দেখা যেতো।
প্রথম কেজিএফ- এর সিক্যুয়াল কেজিএফ-২। ২০১৮ সালে প্রথমটি মুক্তি পায়, কাহিনীর মূল উপজীব্য ছিল এক গ্যাংস্টারের স্বর্ণখনি দখল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে লড়াই। এরপর সাম্প্রতিক কালে মহা ধুমধামে মুক্তি পাওয়া কেজিএফ-২ খুব সম্ভবত ভারতীয় বক্স অফিসের সবচেয়ে বেশি হিট সিনেমার একটি হতে চলেছে।
কেজিএফ-২ এর কিছুদিন আগেই মুক্তি পায় দক্ষিণ ভারতের আরেক প্রতিযোগী তেলেগু ভাষার চলচ্চিত্র- আরআরআর, এখনও যা উত্তর ভারতের বড়পর্দা জুড়ে রাজত্ব করছে।
আরো মাসকয়েক আগে হিন্দিভাষী দর্শকের মন জয় করে নেয় আরেক তেলেগু চলচ্চিত্র ‘পুস্পা’। তখন থেকেই এটির ডায়ালগ ও গানের দৃশ্য ইনস্টাগ্রাম রিলে, হাজারো জনপ্রিয় পোস্টের জন্ম দিয়ে চলেছে।
ভারত এক বিশাল দেশ, বহু ভাষার মানুষের বসবাস সেখানে। রয়েছে আঞ্চলিক সংস্কৃতির বৈচিত্র্য। অনেক সময় যা সার্বজনীন হওয়ার পথেও বাধা। গত কয়েক দশকে সর্বভারতীয় ফিল্ম তৈরির চেষ্টা হয়েছে, অনেক নির্মাতা এমন সিনেমা বানাতে চেয়েছেন যার আবেদন সারা দেশের মানুষের কাছে থাকবে। এদিক থেকে যারা কিঞ্চিৎ সাফল্যের মুখ দেখেছিলেন, তাদের অন্যতম হচ্ছেন দুই তামিল পরিচালক—মনি রত্নম ও শঙ্কর।
তাদের ছবির উপজীব্য কখনো ছিল- ভালোবাসার নাটকীয় পরিণতি, বা জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, যা মানুষকে নাড়া দেয়। আরও সাহায্য করেছে বড় তারকাদের উপস্থিতি আর নির্মাণে বিপুল ব্যয়।
কিন্তু, এমন চেষ্টা হয়েছে কালেভদ্রে। সে তুলনায় বড় বাজেট সব সময় থেকেছে বলিউডি চলচ্চিত্রের দখলে, দর্শক সংখ্যাতেও এগিয়ে ছিল—হিন্দি ভারতের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত ভাষা হওয়ার সুবাদে। সে তুলনায় অন্যান্য ভাষার চলচ্চিত্র, সর্বভারতীয় হওয়ার লক্ষ্যে বিশাল ব্যয়ের ঝুঁকি সেভাবে নেওয়ার আগ্রহ দেখায়নি।
বছর সাতেক আগে সর্বভারতীয় বক্স অফিসে তুমুল সাড়া ফেলেছিল বাহুবলি। তারই পথ ধরে কেজিএফ-২, আরআরআর ও পুস্পার সাফল্য এখন দক্ষিণী সিনেমার সামনে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলেছে।
গণমাধ্যম বিশারদ ভানিতা কোহলি খান্দেকার সর্বভারতীয় আবেদনের সিনেমার বিষয়ে সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে লিখেছেন, “ভারতীয় চলচ্চিত্রের জন্য এর চেয়ে ভালো খবর আর কিছুই হতে পারে না। আরও বেশি টিকেট বিকোচ্ছে আর তাতে আয়ও বাড়ছে।”
পরিবর্তনের এই ধারাকে আরও স্বাগত জানিয়েছেন নন্দিত চলচ্চিত্র-সমালোচক অনুপমা চোপড়া।
মহামারিকালে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়া ছোট বাজেটের দক্ষিণী সিনেমার উন্নত মানের দিকটি উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “দক্ষিণী চলচ্চিত্র শিল্পগুলি অসাধারণ সব ফিল্ম বানাচ্ছে, তারা নতুন দর্শকশ্রেণির মন জয় করছে- যা এক কথায় অভূতপূর্ব। আমার মতে, চলচ্চিত্র শিল্পগুলোর এই মিথস্ক্রিয়া ভারতীয় সিনেমাকে অনেকদূর এগিয়ে নেবে।”
একইসময়, দর্শকের পছন্দ-অপছন্দের এক আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করছে বলিউড। তাই বহু সংস্কৃতি ও ভাষার দর্শকের কাছে আবেদন তৈরি করতে এবং শহুরে দর্শক শ্রেণির স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মমুখী হওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখেই তারা এখন সর্বজয়ী নায়কের চরিত্র-নির্ভর বড় সিনেমা নির্মাণ কমিয়েছে। বেড়েছে তাদের কাহিনির বৈচিত্র্য, জোর দেওয়া হচ্ছে অভিনয়ের পারফরম্যান্সে। তবুও তাদের প্রচলিত দর্শকদের একটি বড় অংশের কাছে তারা আগের মতো আবেদন জাগাতে পারছে না। এই শূন্যতা পূরণের সুযোগ পাচ্ছেন দক্ষিণী নির্মাতারা।
চলতি বছরে এপর্যন্ত বলিউডের সবচেয়ে বড় হিট ‘কাশ্মীর ফাইলস’ একটি বিতর্কিত সিনেমা, যার পেছনে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতো কট্টরপন্থী রাজনীতিকদের সমর্থন।
গত এক দশকে বলিউড শিল্প তার প্রধান তিন সুপারস্টার- শাহ্রুখ, সালমান ও আমির খানের ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরতাও কমিয়েছে। সে তুলনায় দীপিকা পাড়ুকোনে ও আলিয়া ভাটের মতো নায়িকারা শক্তিশালী চিত্রনাট্যের সিনেমার চুক্তি পাচ্ছেন। মূল বলিউডের বাইরের অভিনেতা আয়ুশমান খুরানা ও রাজকুমার রাও- আছেন সে তালিকায়। তারা এখন বহুল আলোচিত গণমাধ্যমের শিরোনামে।
চলচ্চিত্র বাণিজ্য বিশ্লেষক কমল নাহতা মনে করেন, বলিউডের মূল ভোক্তা- দর্শকেরা আজো ব্লকবাস্টার সিনেমা ভালোবাসেন। সেদিন থেকে ভালো চিত্রনাট্য ও দৃশ্যায়নের নির্মাণ করায় বাজারটি ধরে ফেলছে দক্ষিণী শিল্পগুলো। যেমন মহামারির কারণে বলিউডি স্টার- সালমানের বহুল প্রত্যাশিত সিনেমা ‘রাধে’র মুক্তি এক বছর পেছায়। কিন্তু, মুক্তি পাওয়ার পর সেটি ‘ফ্লপ’ করে। যদিও এ সিনেমায় সালমানের অন্যান্য হিট ছবির অনেক ইঙ্গিতবহ সংযোজন ছিল।
গৎবাঁধা চিত্রনাট্য ও অনুকরণীয় কাহিনির জন্য রাধের সমালোচনা করেছেন চলচ্চিত্র বিশ্লেষকরা।
অনুপমা চোপড়া বলেছেন, শুধু বড় বাজেটের বাণিজ্যিক ছবিমুখী হয়ে পড়ে থাকায় আমি মনে করি হিন্দি সিনেমাকে আলস্যে পেয়েছে। কিন্তু, বড় তারকার সাথে ভালো চিত্রনাট্যের যোগসূত্র মিললেই তবে বক্সঅফিসে সাফল্য আসে।”
ভারতের সবচেয়ে বড় বক্সঅফিস সফল চলচ্চিত্র হওয়ার পথে কানাড়া ভাষার কেজিএফ-২। ছবি: ছবি: ইউটিউব স্ক্রিনশট/ ভায়া বিবিসি
কমল নাহতা অবশ্য মনে করেন, বলিউডের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
“অনেকে বলাবলি করছেন বলিউড ও তাদের সিনেমা এবার মরতে বসেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সূর্যবংশী বা গাঙ্গুবাই কাথিওয়াড়ির হিট হওয়ার ঘটনা তা সমর্থন করে না। কাশ্মীর ফাইলস-ও ব্লকবাস্টার হয়েছে।”
পুস্পা, আরআরআর ও কেজিএফ-২ এর পর পর মুক্তিই সাম্প্রতিক এমন উদ্বেগের কারণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
“এতে বলিউডের আস্থায় চিড় ধরেছে, বলিউডি ফিল্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করেন তাদেরও একই মনোভাব।”
তবে দক্ষিণ ভারতের আঞ্চলিক চলচ্চিত্রের এই ব্যাপক আবেদন কিন্তু একদিনে সৃষ্টি হয়নি।
চলচ্চিত্র সাংবাদিক আসিম চাবড়া উদাহরণ দিয়ে বলেন যে, স্পাইডারম্যান বা ব্যাটম্যানের মতো হিন্দিতে ভাষান্তরিত হলিউডি ফিল্মও সমগ্র ভারতের দর্শকের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে। “এসব ঘটনায় প্রমাণ হয়, ভাষান্তরিত সিনেমার বিপুল দর্শক আছে।”
দক্ষিণী সিনেমার আজকের বাজার তৈরিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো। তারা এক দশক আগে থেকেই হিন্দিতে ভাষান্তরিত তেলেগু ছবি সম্প্রচার শুরু করে। ফলে দক্ষিণ ভারতের অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী উত্তর ও পূর্ব ভারতের মানুষের কাছে চেনামুখ হয়ে ওঠেন।
২০১৫ সালে তেলেগু চলচ্চিত্র শিল্প নির্মাণ করে বাহুবলি’র মতো সুপারহিট মুভি। এপর্যন্ত তেলেগু নির্মাতারাই ভারতজুড়ে সবচেয়ে বেশি সাফল্য পাওয়া চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন।
তেলেগু দর্শকরা প্রচলিত রোমান্স, অ্যাকশন, কৌতুকের মতো মিশ্রণ ভালোবাসলেও, এ শিল্পের নতুন নির্মাতারা যোগ করেছেন কাহিনি আরও চমৎকারভাবে উপস্থাপনের দক্ষতা। এমন মন্তব্য করেন শিল্পটির দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষক সাংবাদিক সঙ্গীতা দেভকি।
“এসএস রাজামৌলী (বাহুবলীর পরিচালক) মাগাধিরা ও ইগা ছবি নির্মাণের মাধ্যমে পুরো দৃশ্যপট বদলে দেন। এসব ছবিতে গল্পের আবেগ ও চরিত্রগুলোই অ্যাকশন সিকোয়েন্সকে চালিত করে”- বলেন তিনি।
পাশের রাজ্য তামিলনাড়ুর বাজার ধরেও নিজস্ব নির্মাণ সক্ষমতা ও বাজেট বাড়িয়ে নিতে পেরেছে তেলেগু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। তামিলনাড়ুতেও ভাষান্তরিত তেলেগু সিনেমার কাটতি ভালো হওয়ায়, তাদের আয় ও বাজেট দুই-ই বেড়েছে।
দেভকি আরও জানান, “প্রবাসী তেলেগু ও তামিলদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, তারাও একটি বড় বাজার। এসব কিছু মিলে বড় বাজেটের নির্মাণ সম্ভব হয়েছে।”
তবে হিন্দি সিনেমার জগতে শনির ছায়া নেমেছে, সে কথা হয়তো এখনই বলার সময় আসেনি। আগামীতে বলিউডের তারকা-নির্ভর ছবিগুলো আবার সারা ভারতের প্রেক্ষাগৃহে বাজিমাৎ করতেও পারে। তাছাড়া, দর্শক যেভাবে দিনে দিনে অনলাইন প্ল্যাটফর্মমুখী হচ্ছে তাতে ছোট বাজেটের হিন্দি বা দক্ষিণী যে সিনেমাই হোক- দর্শক হলে গিয়ে আর দেখতে চাইবে কিনা- তা নিয়ে সন্দেহপোষণ করেছেন অনুপমা চোপড়া।
তিনি বলেন, “সর্বসম্মত একটি ধারণা এমন যে, মানুষ শুধু বড় সিনেমার জন্যেই এখন বন্ধু বা পরিজনের সাথে দলবেঁধে হলে আসবে। ছোট সিনেমার ক্ষেত্রে দর্শক কমবে। তবে বড় কোনো তারকাহীন কাশ্মীর ফাইলসের সাফল্য আবার সে ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।” সূত্র: বিবিসি
চিত্রজগত/চলচ্চিত্র