শুক্রবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

প্রয়াণ দিবসে সন্তানদের স্মৃতিতে আবদুল আলীম

বাংলা লোকগানের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল আলীম। -- চিত্রজগত.কম

বাংলাদেশের লোকগানের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল আলীম। পল্লী গানের সম্রাট বলা হয় তাকে। শহর-বন্দর-গ্রাম সব জায়গায় এক সময় তার গানের জয় জয়কার ছিল। তার কিছু কালজয়ী গান এখনো ফেরে মানুষের মুখে মুখে। আজ (৫ সেপ্টেম্বর) আবদুল আলীমের ৪৭তম প্রয়াণ দিবস।

অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন আবদুল আলীম। তার কয়েকটি সাড়া জাগানো গানের মধ্যে রয়েছে, পরের জায়গা পরের জমি, আর কত কাল ভাসব আমি, হলুদিয়া পাখি, বাবু সেলাম বারে বার, শোনো গো রূপসী কন্যা, নাইয়া রে নায়ের বাদাম তুইলা, এই যে দুনিয়া, দুয়ারে আইসাছে পালকি, বন্ধুর বাড়ি মধুপুর, সর্বনাশা পদ্মা নদী রে, উজান গাঙের নাইয়া ইত্যাদি।

আবদুল আলীমের তিন সন্তান আসগর আলীম, জহির আলীম ও নূরজাহান আলীমও সংগীতাঙ্গনের সঙ্গে জড়িত। বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তারা।

আজগর আলীম: বাবার কাছে গানের হাতেখড়ি

বাবার কাছে আমার গান শেখা, গানের হাতেখড়িও তার কাছে। কাজেই বাবা আমার ওস্তাদও। ছোটবেলায় বাবার কাছে গান শেখার স্মৃতি আজও মনে পড়ে।
বাবার কাছে গান শেখার সময় একটি বিষয় খুব করে লক্ষ্য করতাম, গানটি পুরোপুরি না করতে পারলে তিনি গাইতে দিতেন না। বলতেন, ভুল গান করা ঠিক না। আরও বলতেন, গান শেখা শেষ হলেই গাইবে। শুদ্ধভাবে গাইবে।
বাবা বলতেন, মানুষ যেমন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠে, গানের বেলায়ও তাই। গানকেও পরিপূর্ণ গান হয়ে উঠতে দাও, তারপর গাইবে।
কোনো গীতিকারের কাছ থেকে গান নেওয়ার আগেও বাবা খুব ভালো করে গানের কথা পড়তেন। বাছাই করার বিষয়টিও ছিল অন্যরকম। ভালো কিছু হতেই হবে। নইলে তা নিতেন না।
একটি স্মৃতি খুব মনে পড়ছে। বাবা একবার বগুড়ায় একটি গানের অনুষ্ঠান করবেন। তারিখ চূড়ান্ত করে দিলেন। বগুড়ায় কয়েক হাজার টিকিট বিক্রি হয়ে গেল। তখন তো টিকিট কেটে গান শোনার একটা রেওয়াজ ছিল।
অনুষ্ঠানের দিন আমার প্রচণ্ড জ্বর, বাবা যেতে পারলেন না। আমাকে নিয়ে অস্থির হয়ে পড়লেন। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর বাসায় এসে সেবা করতে লাগলেন। বাবা ভুলে গেলেন বগুড়ায় তার শো-এর কথা। সন্তানদের তিনি এতটাই ভালোবাসতেন।
ওদিকে বগুড়ায় হাজারো মানুষ এসেছেন আবদুল আলীমের গান শোনার জন্য। একসময় দর্শকরা শিল্পীকে না পেয়ে স্টেজ ভেঙে ফেলেন। আয়োজকদের অপমান করেন।
পরে অবশ্য আয়োজকরা বাবার কাছে এসেছিলেন। বাবাকে সব বলেছিলেন। বাবা বলেছিলেন, আজগরের খুব জ্বর ছিল। আমার কাছে সন্তানের সুস্থতা সবার আগে। বাবা এতটাই ভালোবাসতেন আমাদের।
বাবা আমাকে নানা জায়গায় গান গাওয়াতে নিয়ে যেতেন। বাংলা একাডেমি, ইঞ্জিনিয়ারর্স ইনস্টিটিউশনসহ অনেক জায়গায়। স্টেজে বাবা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন। তারপর বাবার গাওয়া গানই আমি গাইতাম। সর্বনাশা পদ্মা নদী, হলুদিয়া পাখি, রূপালি নদী…গানগুলো বেশি প্রিয় আমার।

জহির আলীম: বাবা ছিলেন সরল মানুষ

বাবাকে মিস করি খুব। একটি বিষয় বেশি মনে পড়ে। তা হচ্ছে-বাবা আমাকে প্রায়ই বাজার করতে নিয়ে যেতেন। যাদের কাছ থেকে বাবা জিনিসপত্র কিনতেন, তারা বাবাকে কতটা ভালোবাসতেন, সম্মান করতেন—কাছ থেকে না দেখলে কোনোদিন বুঝতে পারতাম না।
একবার বাবার সঙ্গে মালিবাগ যাচ্ছিলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর রেলগাড়ির সিগন্যাল পড়ে। বাবাকে দেখে একটি লোক গেয়ে উঠেন, নাইয়া রে নায়ের বাদাম খুইলা।
বাবা লোকটিকে কাছে ডাকেন। লোকটি বলেন, ওস্তাদ আপনি তো বড় শিল্পী। আপনার গান খুব পছন্দ করি। আমি আপনার ভক্ত। তাই গাওয়ার চেষ্টা করলাম। বাবা হাসতে হাসতে লোকটিকে বিদায় দিয়েছিলেন।
বাবার সঙ্গে যেখানে যেতাম ভক্তরা ভিড় করতো। বাবার হাত ধরে ভক্তরা বলতেন, আপনার গান খুব পছন্দ করি। আপনি বড়মাপের শিল্পী।
একবার বাবাকে দেখতে কুমিল্লা থেকে একজন এসেছিলেন। প্রথমে আমার সঙ্গে কথা বলেন লোকটি। বাবা জানালা দিয়ে দেখতে পান দৃশ্যটি। আমাকে ডাকেন। সব বলি। বাবা ডাকেন লোকটিকে। লোকটি বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করেন। তারপর বলেন, আপনাকে সামনা সামনি দেখতে পারব কল্পনাও করিনি।
বাবা ছিলেন সহজ-সরল মানুষ। মানুষ বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। বাবার গান কোথায় শোনা যায়নি? সবখানে। এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে বাবার গান। এটাই আমাদের জন্য বড় গর্ব।
মানুষ ভালোবেসে বাবাকে পল্লীগানের সম্রাট বলেন। এটাও ভালো লাগে।

নূরজাহান আলীম: রান্না করতে পছন্দ করতেন বাবা

আমার বাবা আবদুল আলীম কত বড় শিল্পী ছিলেন, তা বলতে পারবেন এদেশের মানুষ। তবে, সন্তান হিসেবে শুধু বলব, বাবার মনটা ছিল আকাশের মতো বড়। সেই বিশাল মন নিয়ে আমাদের ভালোবাসতেন। দেশের মানুষকে ভালোবাসতেন।
বাবা একসঙ্গে গান ও সংসার সামলাতেন। তার গানের ভক্ত ছিল অসংখ্য। যেখানেই যেতেন, গান শোনার জন্য মানুষ ভিড় করত।
বাবার একটি গুণের কথা আজ বলি। বাবা রান্না করতে পছন্দ করতেন। ঈদ হোক, বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান হোক, তিনি রান্না করতেন। রান্না করতে ভালোবাসতেন। আবার রান্না শেষে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে খেতেও পছন্দ করতেন।
বাবা আমাদের ভাই-বোনদের পড়ালেখার বিষয়ে খুব জোর দিতেন। তিনি চাইতেন আমরা পড়ালেখা করি। ভালো মানুষ হই। সন্তান হিসেবে গর্ব করি, একজন আবদুল আলীমের গান এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এটাই বড় প্রাপ্তি সন্তান হিসেবে। সূত্র: ডেইলি স্টার বাংলা

চিত্রজগত ডটকম/সঙ্গীত

সংশ্লিষ্ট সংবাদ