বুধবার, ২২শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

দিলারা জামান: একজন ৮৩ বছরের তরুণী

দর্শকপ্রিয় অভিনেত্রী দিলারা জামান। -- চিত্রজগত.কম

দিলারা জামান। অভিনয়ের আঙ্গিনায় তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছেন। ১৯৯৩ সালে একুশে পদক প্রদান করা হয় খ্যাতিমান এই শিল্পীকে। ষাট বছর ধরে অভিনয় করছেন। কালজয়ী বহু চরিত্র উপহার দিয়েছেন, যা দর্শকের মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল। বয়সের কাছে হার না মেনে কাজ করে যাচ্ছেন নিয়মিত। অভিজ্ঞতায় যেমন পরিপক্ব, তেমনি ইন্ডাস্ট্রির মানুষগুলোর কাছে স্নেহ-মমতার জন্যও তিনি গুরুত্বপূর্ণ। একান্ত আলাপচারিতায় জানিয়েছেন তার অভিনয় ক্যারিয়ার, অভিজ্ঞতা ও সাম্প্রতিক শোবিজের নানা গল্প।

কেমন আছেন আপনি?
বেঁচে আছি এটাই শুকরিয়া। গত বছর বাসায় পড়ে গিয়ে আহত হয়েছিলাম। এরপর থেকে শরীরটা আগের মতো আর ভালো নেই। যার কারণে বছরের একটা সময় এখনও কোমরে ব্যথা আসে। এই বয়সে খুবই কষ্টদায়ক এ ব্যথা। এ ছাড়া মোটামুটি ভালো আছি।

নিয়মিত কাজ করতে পারছেন?
হ্যাঁ। নাটকের শুটিং করছি নিয়মিত। যার মধ্যে ধারাবাহিক নাটক বেশি। জীবিকার প্রয়োজনে কাজ তো করতে হবে। কাজ না করলে খাব কি। তবে আউটডোর শুটিং থাকলে যেতে একটু কষ্ট হয়। তাই ঢাকার আশপাশের শুটিং স্পটগুলোতে শুধু কাজ করি। এর থেকে বেশি দূরে হলে এখন আর যেতে পারি না। কেউ অনুরোধ করলেও তাকে বুঝিয়ে বলি। কারণ বয়স তো আর কম হলো না। ৮৩ চলে। অনেক তো হলো বেলা।

অভিনয়ে কত বছর কাটল?
৬০ বছরের বেশি সময় ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছি। শুরু হয়েছিল সেই ১৯৬৬ সালে। সে বছরের ডিসেম্বর মাসে একটি টিভি নাটকে শুটিং করেছিলাম। সেটিই প্রথম। পথচলা শুটিং করতে পারছি। ইনশাআল্লাহ যতদিন বাঁচব, ততদিনই চলবে। বলতে গেলে অভিনয়টি আমার কাছে অক্সিজেনের মতো। এই একটি কাজ করেই আমি হৃদয় থেকে তৃপ্তি ও শান্তি পাই। তাই যতদিন বাঁচি অভিনয় চালিয়ে যেতে চাই।

দীর্ঘসময় ধরে কাজ করছেন, কখনও ক্লান্তি আসে না?
ক্লান্ত কেন হব? বরং অভিনয় না করতে পারলে নিজেকে ক্লান্ত লাগে। অস্থির লাগে। বয়স হয়েছে সে ঠিক আছে, কিন্তু বয়সের কাছে হেরে গেলে তো চলে না। হেরে গেলেই বয়সটাকে বেশি ভারী মনে হবে। তাই আমি বিশ্বাস করি, কাজ করে যেতে হবে। ক্লান্তি এলে তো আর সামনে এগোনো যাবে না। নিজেকে সব সময় বয়সের বাধা থেকে উন্মুক্ত রেখে কাজ করার চেষ্টা করি। আমার জীবনের প্রায় পুরোটা সময় এ পেশায় কাটিয়েছি। এই বয়সে এসে দেখছি, অভিনয়ই আমার কাছে বড় শক্তি। লাইট-ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে আমি সেই শক্তিটা খুঁজে পাই বলেই বয়স আমাকে কাবু করতে পারেনি। আসলে জানো তো, মনের জোর হচ্ছে সবচেয়ে বড় জোর। যেখানে ক্লান্তি আসার কোনো সুযোগ নেই। তাই শরীরের বয়স হলেও মনের দিক থেকে আমি নিজেকে ভাবি ৮৩ বছরের তরুণী।

আপনি কয়েক দশকের সাক্ষী। বর্তমান ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সেই সব সময়ের মধ্যে কি কি পরিবর্তন দেখতে পান?

আমার শুরু তো সেই দেশ স্বাধীনের আগে থেকে। সে সময় মুসলিম নারীদের অভিনয়ে আশা ছিল এক রকম বিপ্লবের মতো। আমার পরিবারও শুরুতে চায়নি আমি অভিনয়ে আসি। আমি তাদের মধ্যে সেই বিশ্বাস তৈরি করতে পেরেছিলাম যে এখানে খারাপ কিছু নেই। তাই আমার পরিবার আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে। তারা না চাইলে আমি জীবনে এই অবস্থানে কোনোদিনও আসতে পারতাম না। এ সময়ে আমি অনেক পরিবর্তন দেখেছি। ৮০-৯০ পর্যন্ত দেশের নাটক-সিনেমা নিয়ে খুব ভালো একটা চর্চা ছিল। দর্শকরা তারকাদের ভালোবাসতেন। তাই তারকারাও কাজের ক্ষেত্রে দর্শকদের কথা মাথায় রেখে কাজ করতেন। নাটক-সিনেমার নির্মাতাদের মধ্যে গবেষণার একটি ব্যাপার ছিল। তারা প্রচুর পড়াশোনা করতেন। সমাজের নানা বিষয়কে সূক্ষ্মভাবে অবলোকন করতেন। যা এখন নেই বললেই চলে।
এখন কাজ হচ্ছে প্রচুর। কিন্তু দর্শকের মনে টিকে থাকার মতো কাজ কম। হুট করে কিছু একটা নিয়ে হইচই হয়, কিছুদিন পর সেটা আর মনে থাকে না কারও। তারপর বলা যায় আগে প্রস্তুতি নিয়ে কাজ হতো। কারণ কাজটাকে সাধনার ভাবা হতো। নিখুঁত করার তাগিদ ছিল। যেকোনো একটি কাজ করতে গেলে আমাদের দিনের পর দিন রিহার্সেল করে, সবার সঙ্গে একটি সম্পর্ক তৈরি করতে হতো। এতে করে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে স্ক্রিপ্ট আমাদের মুখস্থ হয়ে যেত। এখন শুটিং সকালে শুরু বিকালে শেষ। তার পরের দিন ইউটিউবে মুক্তি। না তৈরি হয় চরিত্রটির সঙ্গে শিল্পীর কোনো সম্পর্ক, না নিজেদের মধ্যে আসে আন্তরিকতা। এভাবেই চলছে। চলে যাচ্ছে।

আমাদের এই পথচলার গন্তব্যটা তাহলে কোথায়?
ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা না করে ভালো করার চিন্তা করতে হবে। তাহলে এমনিতেই ভবিষ্যৎ ভালো হয়ে যাবে। শুধু আমাদের ইন্ডাস্ট্রি না, পৃথিবীর সব ইন্ডাস্ট্রিতেই ভালো কাজের পাশাপাশি কিছু দুর্বল কাজও হয়। লোকে ভালো কাজের কথাই মনে রাখে। আমাদের এখানেও ভালো কাজ হচ্ছে। ভালো কাজ না হলে ইন্ডাস্ট্রি তো আর এতদিন টিকে থাকত না। গ্ল্যামার বা চাকচিক্যের প্রচারে সেগুলো আলোকিত না হলেও একটা সময় এই কাজগুলোই সময়ের প্রতিনিধিত্ব করবে। দুর্বল কাজগুলো হারিয়ে যাবে। এটাই নিয়ম। আগেও অনেক দুর্বল কাজ হয়েছে। সেগুলো কেউ মনে রাখেনি। কিন্তু কিছু নাটক আছে, সিনেমা আছে যেগুলোর কথা দর্শক আজও ভাবে, নস্টালজিক হয়, ইউটিউবে সেগুলো খুঁজে খুঁজে দেখে। অভিনেতা, অভিনেত্রী ও পরিচালকদের একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, সেটি হচ্ছে মানসম্মত কাজ না করলে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই অল্প কাজ করেন, কিন্তু মানসম্মত করেন। তাহলেই ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে পারিশ্রমিক নিয়ে কখনও কারও সঙ্গে আপনার ঝামেলা হয়েছে?
এই বিষয়ে আর কী বলব। কত মানুষের কাছে যে পারিশ্রমিক বাকি! আমার ডায়েরিতে লেখা আছে সব। তবে তা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই, আর ছিলও না কোনো দিন। কারণ জীবনই তো লেনাদেনার। যেভাবে যাচ্ছে জীবন, এভাবেই চলে যেতে পারলেই আমি খুশি। আমাকে যারা ইচ্ছে করে ঠকাতে চেয়েছেন সেটা তাদের মানসিকতার ব্যাপার। আমি কারও ওপর রাগ-ক্ষোভ রাখি না। আমি এক জীবনে অনেকের ভালোবাসা পেয়েছি। রাষ্ট্রের কাছে, এ দেশের মানুষের কাছে আমি সব সময় সম্মান পেয়েছি। এসবই অমূল্য পারিশ্রমিক আমার কাছে। এ অনুভূতি নিয়েই আমি বেঁচে থাকতে চাই।

চিত্রজগত ডটকম/টেলিভিশন

সংশ্লিষ্ট সংবাদ